আপনি একজন চালাক ব্যক্তি রাইট? কিন্তু টেক কোম্পানি রা খুব ভালোভাবেই জানে কিভাবে আপনার মতো চালাক ব্যক্তির পকেট থেকেও এক্সট্রা টাকা খসানো যায়, এমন কি আপনার প্রয়োজন হোক কিংবা না হোক। এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো, কিভাবে টেক কোম্পানি গুলো তাদের এক্সপেন্সিভ প্রোডাক্ট কেনানোর জন্য আপনার সাথে মাইন্ড গেম খেলে। বিশেষ করে দামি স্মার্টফোন কেনার ক্ষেত্রে, তবে এই ট্রিক প্রত্যেকটা এক্সপেন্সিভ প্রোডাক্টের সাথেই কম বেশি এমন ভাবেই কাজ করে।
তাহলে দামি স্মার্টফোন কেনার কোনই দরকার নেই? এইটা কি সম্পূর্ণই লস প্রজেক্ট? উত্তর সরাসরি “হ্যাঁ” বা “না” তে ইতি না টেনে চলুন এই টপিকের গভীর কুয়ায় ঝাঁপ দেওয়া যাক!
স্মার্টফোন একটি অবচয় ব্যয়
বাংলায় “অবচয়” শব্দের অর্থটা এমন, যেটার সময়ের সাথে সাথে মূল্য হ্রাস হয়। দামি স্মার্টফোন বা যেকোনো স্মার্টফোন এমন ক্যাটাগরিতেই পরে যেটার কেনা দাম আর ১ বছর পরের দামের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য চলে আসতে পারে। তাছাড়া এটা এমন ক্যাটাগরির প্রোডাক্টের মধ্যেও পরে, এক তো আপনি একসাথে লাখ খানেক টাকা ঢাললেন, কিন্তু জিনিসটা কন্টিনিউয়াস ব্যবহার করতে থাকার জন্য আপনাকে লাগাতার টাকা খরচ করতেই থাকতে হবে। তো এই কারণেই আপনি লাখ টাকার স্মার্টফোন কিনলেও সেটাকে কখনো সম্পদ বলতে পারবেন না।
সম্পদ অপরদিকে নিজের দাম ধরে রাখে বা উল্টে কেনা দামের থেকে দুই চার দশ গুন আপনাকে লাভ পাইয়ে দিতে সাহায্য করে। ধরুন, আপনি জমি কিনলেন, এখন জমির দাম তো কমবে না উল্টে দিনের পর দিন আরো দ্বিগুণ, তিনগুণ দাম হতে থাকবে। কিন্তু ১ লাখের ফোন ১ বছর পরে ৬০ হাজারেও বিক্রি করতে ঘাম ছুটে যেতে পারে। তার উপরে দামি ফোনের সব দামি দামি আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র, যেমন: ওয়্যারলেস ইয়ারফোন, দামি স্ক্রীন প্রটেক্টর, দামি কভার কেস ইত্যাদি। শুধু কি এখানেই শেষ নাকি? নিয়মিত ডাটা রিচার্জ, টকটাইম রিচার্জ, ওয়াইফাই রিচার্জ আরো কত আলাদা খরচ? আবার তার উপর কোম্পানি গুলো নতুন মডেল বের করার পরে পুরাতন মডেলের দাম নিজেরাই কমিয়ে দেয়, ফলে আরো লস দিয়ে ফোন বিক্রি করতে হয়।
আজকের দিনে ২৫/৩০ হাজার টাকা রেঞ্জের ফোন গুলো এতো বেটার হয়ে গেছে না, আপনার কখনোই ১ লাখের ফোন কেনার প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু এখানে কথা তো শুধু প্রয়োজনের নয়, আমরা যখন দামি ফোন কিনি, বেশিরভাগ সময় সেটা প্রয়োজনের খাতিরে তো কেনা হয় না, বরং স্ট্যাটাস কেনা হয়, সমাজে আপনি কতখানি দাপট দেখাতে পারবেন সেটা শো করার জন্য কেনা হয়। আর এই সেম সাইকোলজি অলমোস্ট প্রত্যেকটা লাক্সারি আইটেম কেনার সময়ই কাজ করে।
তবে এর মধ্যেও দুইটি ক্যাটাগরির ক্রেতা রয়েছে। ধরুন আপনি একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনেছেন শুধু সখের বসে বা একটু ফ্লেক্স করার জন্য তবে সেটা আপনার জন্য একটি অবচয় ব্যয়। কিন্তু অপরদিকে কেউ যদি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হয়ে থাকেন, ফটোগ্রাফি করে সে ঘর চালায় এমন হয়, তবে এই দামি ক্যামেরা টি কিন্তু তার জন্য একটি সম্পদে পরিণত হয়। ঠিক যেমন আমার হাতের ফোন, বা ল্যাপটপ সবকিছুই আমার প্রফেশনাল লাইফ কে আরো বেটার করার জন্য কেনা। আমি টেকের উপরে ভালো ইনভেস্ট করলে রিটার্ন আরো ভালো আসবে, সুতরাং দামি ফোন বা ল্যাপটপ আমার জন্য একটি সম্পদের সমান। কেননা আমি এগুলো থেকে মুনাফা অর্জন করতে পারছি।
তবে ৯০% টাইম, অন্তত এই আর্টিকেল যারা পাঠ করছেন তাদের জন্য স্মার্টফোন একটি অবচয় প্রোডাক্ট এবং দামি ফোন অলমোস্ট সবাই সখের বসে বা স্ট্যাটাস দেখাতেই কিনে থাকেন। তো পর্যাপ্ত হিসেব বিজ্ঞানের জ্ঞান বণ্টন করলাম এখন একটু স্মার্টফোন মার্কেট ঘুরে আসি।
মিডরেঞ্জ ফোন গুলো এখন অনেক বেটার
অবশ্যই আমি বলবো না যে মিডরেঞ্জ আর ফ্ল্যাগশিপের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু সেটা আপনার জীবনে কতখানি পার্থক্য এনে দেবে সেটাই বড় প্রশ্ন। চলুন ব্যাপার টা আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই শেয়ার করি। আমার মূলত সব বাজেটের একটা করে ফোন রয়েছে। একেবারে ফ্ল্যাগশিপ থেকে শুরু করে এন্ট্রি বাজেট পর্যন্ত। যখন আমি এন্ট্রি বাজেট ফোনটি থেকে মিডরেঞ্জ ফোনটি ব্যাবহার করি, আমি মোটামুটি ভালো উন্নতি লক্ষ্য করি। আমি মিডরেঞ্জে বেটার ক্যামেরা পাচ্ছি যেটা এন্ট্রি বাজেট ফোন থেকে এটলিস্ট ৫/৬ গুন বেশি ভালো। আমি LCD ডিসপ্লে থেকে ডাইরেক্ট OLED ডিসপ্লে পাচ্ছি, 120Hz রিফ্রেশ রেট সাপোর্ট পাচ্ছি, বেটার র্যাম ম্যানেজমেন্ট পাচ্ছি, মানে এক কথায় হুট করে ফুটপাত থেকে উঠে এসে ৪ স্টার হোটেলের মতো একটা ফিলিং পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু মিডরেঞ্জ স্মার্টফোন থেকে যখন আমি ফ্ল্যাগশিপ ফোনে মুভ করছি, আমি ইনস্ট্যান্ট সেই পার্থক্য গুলো লক্ষ্য করতে পারছি না, বা পার্থক্য থাকলেও সেগুলো আমার জীবনে বিরাট কোন ভূমিকা পালন করছে না। হ্যাঁ, ফ্ল্যাগশিপে আমি বেটার চিপসেট পাচ্ছি, আরো বেশি ফাস্ট র্যাম এবং স্টোরেজ পাচ্ছি, আরো ভালো ক্যামেরা পাচ্ছি, বেস্ট কোয়ালিটি মডেম পাচ্ছি, ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্ট পাচ্ছি — কিন্তু এগুলো কোনোটাই আহামোরি কিছু না। ইভেন আমি জীবনে একবারও ওয়্যারলেস চার্জ করে দেখিনি। মূল কথা হচ্ছে দামি স্মার্টফোন আসলেও সেরার সেরা, কিন্তু এর জন্য যতো গুন বেশি আপনাকে মূল্য চার্জ করা হয় ঠিক ততোগুন ভ্যালু বা ফিচার কোনোটাই আপনি পান না।
তাহলে দামি স্মার্টফোন কেনা শুধুই টাকার নষ্ট?
হ্যাঁ, যদি সেটা আপনার দরকারই না হয় তাহলে তো টাকার নষ্টই হলো তাই না? ধরুন আপনি জাস্ট সোশ্যাল মিডিয়া ব্রাউজ করেন অ্যান্ড টুকটাক ফটো তোলা আর ইন্টারনেট ব্রাউজিং, তাহলে আমি একটা ভালো ক্যামেরা ফোনে ইনভেস্ট করবেন রাইট? ASUS ROG সিরিজের ফোন তো দরকার নাই আপনার জন্য। এখন ১০০ এক্স জুম রয়েছে তাই বলে কি আপনি Samsung Galaxy S23 ultra কিনেছেন? বরং “আমার টাকা আছে” এইটা দেখাতে কিনেছেন (বেশিরভাগ সময়)।
আপনার প্রয়োজন বুঝুন সেই অনুসারে স্মার্টফোন কিনুন। বললাম তো মিডরেঞ্জ ফোন গুলোতে আল্ট্রা ফাস্ট চার্জিং থেকে শুরু করে, ভালো চিপসেট, ভালো ক্যামেরা সেটাপ এমন কি বাঁকানো ডিসপ্লে পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। ডেইলি টাস্ক গুলো পারফর্ম করার জন্য আপনাকে বেস্ট ফোন টি কেনার দরকার নেই। ১০ হাজার থেকে ২৫/৩০ হাজার টাকার ফোন কিনলে আপনি যতোটা আপগ্রেড অনুভব করতে পারবেন, ৪০/৫০ হাজারের ফোনে সেই আপগ্রেড অনুভব করতে পারবেন না। আর এই একই আইন ১ লাখ টাকার ফোনের উপরেও প্রয়োগ হয়।
আপনি জাস্ট শখের বসে ৪০/৫০ হাজার রেঞ্জের ফোন কিনতে পারেন কিংবা লাখ টাকার ফোন। অথবা আপনি একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর সেই ক্ষেত্রে। তা ব্যতীত ৩০ হাজারের ফোনে আপনি অলমোস্ট সবকিছু পেয়ে যাবেন যা একটি মডার্ন স্মার্টফোন থেকে আপনি আশা করতে পারেন। আপনার প্রয়োজন বুঝে ফোন কিনুন, কানার মতো দামি স্মার্টফোন কেনা শুধু অর্থের অপচয় ব্যতীত আর কিছুই নয়।
স্মার্টফোন কোম্পানি গুলোর মাইন্ড গেইম
স্মার্টফোন কোম্পানি গুলোও নানান ভাবে পাঁয়তারা করে আপনাকে প্রিমিয়াম মডেল গুলো কেনার জন্য বাধ্য করতে। আরে ভাই ওরা তো প্রপার টিম বসিয়ে রেখেছে যাতে আপনাকে দামি ফোন গুলো গছিয়ে দিতে পারে। এরমধ্যে সবচাইতে বড় হাতিয়ার হচ্ছে এদের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন গুলো। বিজ্ঞাপনে তারা এমন ভাবে দামি ফোন গুলোকে উপস্থাপন করে যেন আপনার বর্তমান হাতের ফোনটি একটা বেকার পিস। আপনি আপগ্রেড করলে অমুক তমুক নানান গিমিক ওয়ালা ফিচার গুলো পেয়ে যাবেন, আর এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি ফিচার হয়তো আপনি প্রথমবার ইউজ করে জীবনে কখনো খুলেও দেখবেন না।
এই মাইন্ড গেইম খুব ভালো ভাবেই কাজ করে, এর জন্য অ্যাপল আইফোনের দাম এতো বেশি হওয়া সত্বেও মানুষ কিনে কখনো শান্ত হয় না। আপনার কাছে এমন একটা ভাব ধরে যে আপনি ফোন নয় বরং একটা অনুভূতি কিনছেন। আর এটা কাজও করে, মাইন্ড গেমে তারা সবাইকে হারিয়ে আপনার টাকা নিজেদের পকেটে ভরে নেয়। তবে শুধু অ্যাপেল কেন? সবাই, অলমোস্ট সব ফোন ব্র্যান্ড এই কাজ করে থাকে। আর আমাদের মাথায় তো আগে থেকে একটা জিনিস আছেই, বেশি টাকা দিয়ে কিনতেছি মানে বেশি ভালো জিনিস। অবশ্যই এটা আমার কারেন্ট ফোন থেকে বেশি ভালো পারফর্ম করবে। কিন্তু সর্বদা তো এমন হয় না।
আপনি ডিসকাউন্টে আইফোন পেয়ে গেলেন, আপনি ১০ হাজারের ডিসকাউন্ট পাওয়ার জন্য ১ লাখ খরচ করলেন। আপনি শুধু দেখতে পাচ্ছেন আপনি ১০ হাজারের ডিসকাউন্ট পেয়েছেন, এতে আপনার ১০ হাজার লাভ হলো, কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন না ১ লাখ ও এক্সট্রা খরচ করলেন, যেটা খরচ না করলেও হতো। আপনার কারেন্ট ফোন হয়তো যথেষ্ট সামর্থবান ছিলো। কিন্তু ঐযে, আপনার বেস্ট জিনিস চাই, আর কোম্পানিরা তো এইটাই চায়।
এই চক্করে ৩০ হাজারের ফোন ওয়ালারা ৫০ হাজারে চলে যাচ্ছে, আর ৫০ হাজারের ফোন ওয়ালারা লাখ পার করে ফেলতে দ্বিধা বোধ করছেন না। এমন কি মানুষ EMI দিয়েও ফোন কেনার জন্য প্রস্তুত। মানে লোন করে হলেও আমাদের দামি স্মার্টফোন কিনতে হবে। বাহ্! কি একটা চমৎকার মাইন্ড গেম?
শেষ কথা
উপসংহার এইটাই, দামি ফোন গুলো কখনোই বেস্ট ভ্যালু ফর দ্যা ম্যানি নয়। আপনার প্রয়োজন মেটানোর জন্য মিডরেঞ্জ ডিভাইস গুলোই বর্তমানে Too Good! আপনার সত্যিকারের অর্থে ফ্ল্যাগশিপ দরকার হলে আপনি কিনতে পারেন। কিন্তু কোম্পানি গুলো আপনাকে অপ্রয়োজনীয় হওয়া শর্তেও দামি স্মার্টফোন কেনাতে বাধ্য করছে। আর এটা এভাবেই চলমান থাকবে। এখানে অনেক সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার রয়েছে। কোম্পানিরা এই লুপ হোল অনেক আগেই খুঁজে পেয়েছে, আর তারা তাদের পজিশন থেকে সফল।